মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের মন্দির সম্পূর্ণ হতে চলেছে। মুঘল আমল থেকে শুরু হওয়ায় যুদ্ধ অবশেষে ৯ই নভেম্বর ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সমাপ্তি ঘটে l এই যুদ্ধ শুধু রাম মন্দির নির্মাণ নয় বরং সনাতনী হিন্দু সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। ভারতবর্ষকে তার অতীত গৌরবের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়াস মাত্র। রাজনীতিজিবীদের কাছে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র জীবিকার উপকরণ হলেও সনাতন হিন্দুদের কাছে এই যুদ্ধ ছিল ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ ও ভারত বর্ষকে পরাধীনতা থেকে বাঁচানোর যুদ্ধ। এখন একটু অতীতকে ফিরে দেখা যাক।
১৫২৭- ২৮ সাল বিদেশি হানাদার বাবরের আদেশে তার সেনাপতি মীর বাকী রাম মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করে। মন্দির ধ্বংসের সময় মন্দিরের দায়িত্বে ছিলেন সিদ্ধ মহারাজ শ্যামানন্দ। শ্যামানন্দ ও ভাটি রাজা মহাতাব সিং বদ্রীনারায়ণ বাবরি সেনার সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ করেন প্রায় এক লাখ ৭৯ হাজার হিন্দুর রক্তে অযোধ্যার মাটি রঞ্জিত হয়। এরপরে দেবীদিন পান্ডে অতঃপর মহারাজ রণবিজয় সিং মুঘল সেনাদের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ করেন এবং বীরগতিপ্রাপ্ত হন। মহারাজের মৃত্যুর পর তার পত্নী রানী, জয়রাজ কুমারী মুঘল সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং হুমায়ুনের রাজত্বকাল পর্যন্ত যুদ্ধ জারি রাখেন। স্বামী মহেশ্বরানন্দ সন্ন্যাসীদের একটি সেনাদল তৈরি করে রানীর সঙ্গে যোগদান করেন এবং যুদ্ধে উভয়ই বীরগতি প্রাপ্ত হন। রাম জন্মভূমি পুনরায় মুঘলদের দখলে চলে যায়। এরপর ঔরঙ্গজেব প্রায় ১০ বার রাম জন্মভূমি আক্রমণ করে অবশিষ্ট অংশ ও মূর্তি ধ্বংস করে দেয়। গুরু শ্রী রামদাস মহারাজের শিষ্য শ্রী বৈষ্ণব দাস রাম জন্মভূমি উদ্ধারের জন্য প্রায় 30 বার মুঘল সেনাদের আক্রমণ করেন। নবাব ওয়াজিদ আলী শায়ের সময় হিন্দুরা মন্দিরা আক্রমণ করেন এবং দুইদিন ধরে প্রবল যুদ্ধের করে রাম জন্মভূমি উদ্ধার করেন এবং সেখানে একটি ছোট্ট রাম মন্দির নির্মাণ করেন। বিবাদ চলতেই থাকে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বাবরি মসজিদ প্রথম ধ্বংস করা হয় তখন ব্রিটিশ কালেক্টর এটাকে পুনরায় নির্মাণ করেন। ১৯ জানুয়ারি ১৮৮৫ সাল মোহন্ত রঘুবীর দাস ফয়জাবাদ আদালতে মামলা করেন রাম জন্মভূমি উদ্ধারের জন্য।পুনরায় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ এর কিছু অংশ ধ্বংস করা হয়। এইভাবে চলতে চলতেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সালে সরকার মুসলমানদের বিবাদিত জায়গা থেকে দূরে থাকতে বলেন এবং প্রধান দরজায় তালা দিয়ে দেয়। ১৯৫৯ সাল নির্মহী আখারা উত্তর প্রদেশ আদালতে ওয়াকফ বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আদালতে মূর্তি পূজার অনুমতি চান। ১৯৮৬ সাল উত্তর প্রদেশ হাইকোর্ট রাজীব গান্ধী সরকারকে আদেশ করে রাম মন্দিরের দরজা খুলে দিতে। এরপর নভেম্বর ১৯৮৯ সাল এলাহাবাদ হাইকোর্ট অনুমতি দেয় ২.৭৭ একর জমিতে রাম মন্দিরের শিলান্যাস করার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বুটা সিংকে উত্তর প্রদেশ পাঠান এবং ফয়জাবাদ জেলা কালেক্টর এর কাছে আন্ডারটেকিং নেন যে বাবরি মসজিদের ভিতর কোন শিলান্যাশ হবে না। শুরু হলো নির্বাচনী এজেন্ডা। রাজীব গান্ধী নির্বাচনের সময় প্রচার শুরু করেন এই বলে যে তিনি "রাম রাজ্য" ফিরিয়ে আনবেন।। অন্যদিকে বিজেপি ১৯৮৯ সালে তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে রাম মন্দির নির্মাণ প্রসঙ্গ আনেন। রাম মন্দিরের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। এই আন্দোলনের অভিমুখ পরিবর্তন করে কিভাবে ভোটে রূপান্তরিত করা যায় এই ছিল রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্য। ১৯৯০ সাল কর সেবকরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অযোধ্যায় জড় হতে শুরু করে। অন্যদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি এই আন্দোলন নিজেদের হাতে নেবার জন্য রথ যাত্রার সূচনা করে। এই রথযাত্রার নেতৃত্ব দেন এল কে আদবানী। কর সেবকরা অযোধ্যায় রাম মন্দিরে আশেপাশে আন্দোলন শুরু করলে তৎকালীন উত্তর প্রদেশ সরকার এর মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব করসেবকদের ওপর গুলি চালানোর আদেশ দেন। ২ নভেম্বর ১৯৯০ সাল মুলায়েম সিং এর পুলিশের গুলিতে বহু রামভক্ত প্রাণ হারান ,অযোধ্যার বাতাস বারুদের গন্ধে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এর ফল ূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূস্বরূপ ১৯৯১ সালে তাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্থফা দিতে হয়। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সাল কর সেবক দের প্রচেষ্টায় বাবরি মসজিদ ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নিজেদের কাঁধ থেকে এই দায় ঝেড়ে ফেলে। অটল বিহারী বাজপেয়ি বিবৃতি দেন যে তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করতে চাননি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং ব্যক্তিগতভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন এর ফলে তার সরকার বরখাস্ত হয়। কেন্দ্রে তখন পি ভি নরসীমা রাওয়ের সরকার, তিনিও কর সেবকদের ওপর পুলিশি ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেন।
২০০৩ সাল হাইকোর্ট অর্ডার দেয় A.S.I কে, বাবরি মসজিদ চত্বরে খনন কার্য করার জন্য। এই খনন কার্যের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন কে কে মোহাম্মদ। খনন কার্যে রাম মন্দিরের স্বপক্ষে প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই প্রমাণগুলি রাম মন্দির রায়দানের স্বপক্ষে কাজে লাগে। ২০১০ সাল এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দান করে বিতর্ক প্রতিযোগী তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়ার জন্য । সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে এক ভাগ, নির্মহী আখারাকে একভাগ, রামলালা পিটিশনার কে এক ভাগ দেওয়ার জন্য।। ২০১১ সাল সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেয়। পুনরায় আবেদন করলে ৬ই আগস্ট ২০১৯ থেকে প্রতিদিন সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শুরু হয়। ২০১৯ সালেই তৎকালীন বিজেপি সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানায় ৬৭ একর জমি প্রকৃত মালিক কে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ তৎকালীন সরকার চাননি রাম মন্দির নির্মাণ হোক। সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে আসে সেই শুভক্ষণ। ৯ নভেম্বর ২০১৯ সাল সর্বোচ্চ আদালত রায়দান করে ২.৭৭ একর জমিত রাম মন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দেওয়া হয় এবং পাঁচ একর জমি মুসলিম পক্ষকে তাদের মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়। বিজেপি সরকার এর কৃতিত্ব নিতে ছুটে আসে কিন্তু রাম মন্দির নির্মাণের জন্য এই সরকারের ন্যূনতম ভূমিকা ও ছিল না। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে তাদের উপস্থিতি এই রায়কে প্রভাবিত করেছে তাহলে অপরপক্ষে বলা যায় পাঁচ একর জমিও এই সরকারের জন্যই মুসলিম পক্ষকে দেওয়া হয়েছে।। তাহলে সত্যিই কি হিন্দুরা ন্যায় বিচার পেয়েছে? নাকি সরকার ও আদালত একটি বোঝাপড়ার মাধ্যমে উভয়পক্ষকে খুশি করেছেন। যাতে দীর্ঘদিনের বিবাদ নিরসন করা যায়।
No comments:
Post a Comment