রচনা :- অরিন্দম রায়।
আমাদের "রায় পরিবারের" পারিবারিক দূর্গা পূজা......।
হুগলি জেলার হরিপাল থানার অন্তর্গত "তারকেশ্বর" যাবার পথে "নালিকুল স্টেশন"(প্রাচীন নাম ছিলো "নদী-কুল{নদী টির নাম "কুশি নদী"} অপভ্রংস হয়ে পরিণত হয়েছে 'নালিকুল') এই স্টেশনের থেকে 3.21 কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত "বন্দিপুর" এক প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ গ্রাম। বন্দিপুরের সবথেকে সুপরিচিত প্রাচীন বংশ হলো আমাদের "রায় বংশ"।
আমাদের পরিবারের "বিস্তৃত সু-মুদ্রিত কুলপঞ্জী" আজও আছে এবং আমার কাছেও আছে।
তার থেকে জানা যায় যে, আমাদের বংশের আদি পুরুষ ছিলেন রাজপুতানা বা আজকের রাজস্থানের "রানা লক্ষণ সিংহ"।
তার পরবর্তী বংশধর "রায় রায়ান রাঘব রাম" তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন, "মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের" রাজত্বকালে 1605 থেকে 1627
খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
তাঁর পরবর্তী বংশধর খ্যাতনামা জমিদার "রায় মধুসূদন সিংহ," যিনি ছিলেন অষ্টাদশ পুরুষ। তিনি বন্দিপুরে অনেক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ পরিবারকে বহু ভূসম্পত্তি দান করেছিলেন। ওই সকল নিষ্কর(অথাৎ Tax নিতাম না আমারা) জমি-জমার বর্তমান মালিকরা গত ইংরেজ আমলে জরিপের সময় যেসব দলিলপত্র দাখিল করেন, সেই সব কাগজে ঐ জমি গুলির ''দাতা'' হিসাবে আমাদের পরিবারের নাম লিখিত আছে। "রায় রায়ান রাঘব রামের" চতুর্দশ বংশধর ছিলেন খ্যাতনামা জমিদার "রায় কুঞ্জলাল সিংহ"।
তিনি "তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সম্মেলনে" পশ্চিমবঙ্গের পক্ষ থেকে
প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি "রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন" এবং "সরস্বতী" উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। ইংরাজির 1926 খ্রিস্টাব্দে তিনি অমৃতলোকের উদ্দেশে পঞ্চভূতে বিলীন হন।
বন্দিপুর এর শ্রীবৃদ্ধি ও প্রসিদ্ধিতে, আমাদের 'রায় বংশের' অবদান যথেষ্ট।।
রায় বংশোদ্ভূত জমিদারেরা এই গ্রামে এবং তার আশপাশে কামার, কুমোর, ধোপা, নাপিত, মালি, মুচি, ডোম, বাইতি, গোয়ালা ইত্যাদি মানুষজন কে ভূমি দান করে তাদের বসবাসের পাকাপাকি ব্যাবস্থা করে দিয়ে গ্রামবাসীদের অসীম উপকার সাধন করেছিলেন। তা ছাড়া এই গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় আজ যে বসু, আচার্য, ঘটক, চক্রবর্তী, চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি যে সমস্ত বনেদি হিন্দু পরিবার রয়েছেন তাদেরকেও এককালে জমি দান করে বসিয়েছিলেন আমাদের রায় বংশীয় জমিদাররাই। রায় বংশীয় জমিদারগণ পূজা-পার্বণ,
দেব-দরিদ্র সেবা ইত্যাদি বাবদ ব্যয় নির্বাহের জন্য 360 বিঘা ভূসম্পত্তি "দেবোত্তর" করে দিয়েছিলেন বলে
আমার পিতামহের(Grand Father) নামে যে 'জীবনী গ্রন্থ' আছে তার থেকে এবং অন্যান্য সরকারী দলিল দস্তাবেজ থেকেও এই কথা জানা যায়।
আমার, পিতামহ(Grand Father) স্বর্গত বিজয়কৃষ্ণ রায় মহাশয়, অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত(MA, MSC, BA, BT) ইংরাজি, হিন্দি, বাংলা ভাষা ব্যতীত সংস্কৃত, পালি এবং নেপালি ভাষায় তাঁর বিশেষ পাণ্ডিত্য ছিলো। স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ এবং সমাজ সংস্কারক হিসাবে হুগলি জেলায় তিনি অত্যন্ত খ্যাতনামা ব্যাক্তিত্ব ছিলেন।
1975 সালে
তাঁর মহাপ্রয়াণের সময় আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। আজও সেই দিনটি অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে আমার স্মৃতিপটে ধরা রয়েছে। পরবর্তীতে "বিজয়কৃষ্ণ রায় জন্মশতবর্ষ উদযাপন সমিতি" স্থাপিত হয়।
এমন একটি বংশের উত্তরাধিকারী("বড় নাতি) হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে পেরে আমি সত্য সত্যই "ধন্য".....!!!
আমাদের এই পারিবারিক মহাপূজা প্রায় 350 বছরে ধরে মহাআড়ম্বরে পূজিত হয়ে আসছে। হিসাব মতো 1670 খ্রিস্টাব্দের থেকে আমাদের এই পারিবারিক পূজা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে স্বমহিমায় চলে আসছে। তখন মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমল।
আমাদের প্রতিমার এই বছর মহা নবমী এবং মহা দশমী দিনের (23/10/2023) স্থিরচিত্র এবং দ্বিতীয়টি 24/10/2023 "মহা দশমী" দিনের" স্থিরচিত্র এবং ভিডিও এখানে সংযোজিত করেছি।
এখানে উল্লেখ্য বিষয় এই যে আমাদের পারিবারিক দূর্গা প্রতিমা হলেন চতুর্ভূজা। কারন "রাজপুতানায়" অথাৎ আজকের "রাজস্থানে" দেবী দূর্গা, "অম্বিকা" বা "অম্বা" নামে পূজিতা হন। যেহেতু আমাদের বংশের আদি উৎস "রাজপুতানা" অধুনা "রাজস্থানের" থেকে, তাই আমাদের আরাধ্য পারিবারিক দূর্গা প্রতিমা, রাজস্থানি পরম্পরা মেনে দেবী "চতুর্ভুজা"। অথাৎ তিনি হলেন রাজস্থানি "দেবী অম্বা"।
আর একটি বিষয় না বললেই নয়, রাজপুতানার প্রাচীন পরম্পরা মেনে আজও দেবীর বিদায় বেলায় "বরন" শুধু মাত্র পুরুষ সদস্যরাই করতে পারেন। কারন সেই যুগে "ক্ষত্রিয় রাজবংশের নারীগণ" রাজ্যের সাধারণ নাগরিকদের সামনে আবির্ভূতা হতেন না।
এখানে আরো একটি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য বিষয় হলো আমাদের মহিষাসুর এর গাত্রবর্ণ সম্পূর্ণ সবুজ। কারন আমরা রাজপুত ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত প্রতিটি নারী ও পুরুষের জন্মগত জাতশত্রু হলো বহিরাগত মরুদস্যু
আক্রমণ-কারিরা। যারা আমাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষেকে তিন টুকরো করে দিয়েছে, আফগানিস্তান কে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে এবং এখনো আরো খন্ডিত করবার নানা চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতবর্ষের মধ্যে রাজস্থানের মাটিতে দেশপ্রেম এবং সনাতন বৈদিক হিন্দু ধর্মের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও আস্থা বিশেষভাবে শত শত বছর ধরে পরিলক্ষিত হয়।
সর্বশেষ হিন্দু রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান 1192 খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহাম্মাদ ঘৌরির হাতে পরাজিত ও বন্দি হন। এর ফলে ভারতবর্ষ আগত আটশো বছরের জন্যে এই আসুরিক শক্তির দ্বারা পরাধীন হয়ে যায়। কিন্তু এই পরাধীনতাকে হিন্দু বীরের জাত রাজপুতগন কোনো দিনই মেনে নিতে পারেননি। তাই তাঁরা অসুররূপী এই দানব গোষ্ঠী কে দেবীর পদতলে সবুজ রঙের মহিষাসুর রূপে ত্রিশূল বিদ্ধ করে, মা এর বিচারের প্রতীক্ষায় তাঁর চরণ তলে স্থাপনা করেছেন। এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাথা উঁচু করে লড়াই চালিয়ে গেছেন আর আজও যাচ্ছেন এই অসুর কুলের বিরুদ্ধে।
আর সেই জন্যেই একসময় বাদশাহ আকবর কে পর্যন্ত রাজপুতগনের সাথে মিত্রতা স্থাপনা করে
যোধাবাঈ কে বিবাহ বা নিকাহ্ করতে বাধ্য হতে হয়। কারন আকবর অনুভব করতে পেরেছিল, রাজপুতগন এমনই বীরের জাত যে, তারা নিজেদের মাথা কাটাতে পছন্দ করবে, কিন্তু তবু তাঁরা আসুরিক শক্তির সামনে মাথা নত করবে না।
আর সেই কারনেই রাজস্থানি রীতি মেনেই "আমাদের অসুরের রঙ সবুজ"।
যেহেতু এই অসুর কুলের মজহব্ বা Religion এর মান্যতা প্রাপ্ত "রঙ" হলো "সবুজ"। তাই আমাদের মাতৃ প্রতিমার নীচে ত্রিশূলে বিদ্ধ যে অসুর কে দেখা যাচ্ছে তার দেহের রঙও সবুজ।
আর দেবীর বাহন সিংহ কিছুটা ঘোড়া ও সিংহের মিলিত রূপ। একে "করাল সিংহ" বলা হয়।
দেবী দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহ শৌর্য এবং বীর্যের প্রতীক।
রাজার রাজকীয়তায় এবং যুদ্ধবিগ্রহের প্রধান সঙ্গী হলো ঘোড়া।
যুদ্ধের দেবী হলেন আজকের এই মহিষাসুরমর্দিনী আর তার বাহন সিংহের বিশেষত পিছনের অংশটি ধীরে ধীরে ঘোড়ার আকার ধারণ করলো মৃৎশিল্পীর হাতের কলা কৌশলে। যার নাম হলো "করাল সিংহ"। এই ঘোড়া এবং সিংহের সংমিশ্রণ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব বেশ কিছু শতাব্দী পূর্বে।
সেই ধারা আজও আমাদের মাতৃ প্রতিমা বহন করে
চলেছেন।
এছাড়া বাংলার অনান্য কিছু বনেদি বাড়ির দূর্গা পূজা গুলিতেও এই একই ধারা লক্ষিত হয়।
এখানে আর একটি কথা না বললেই নয়, সেটি হচ্ছে যে আমাদের কুলদেবতা হচ্ছেন
শ্রীশ্রী গোপীজনবল্লভ জীউ। তাই বৈষ্ণব রীতি মেনেই আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা করা হয়।
এখানে স্বাভাবিক ভাবেই যে কোনো মানুষ প্রশ্ন করতেই পারেন, তাহলে নিশ্চয় আপনাদের দেবীর পূজা পদ্ধতিতে পশু বলি বা ছাগ বলি নিষিদ্ধ ?
এক্ষেত্রে আমাদের উত্তর হল এই যে, বৈষ্ণব পদ্ধতিতে মেনে পূজা হলেও আমাদের পশুবলি দেবার প্রথা রয়েছে। এর এক মাত্র কারণই হল, আমাদের আদি উৎস রাজস্থানের রাজ ঘরানা, রানা লক্ষন সিংহের পরিবার। তাঁর তৃতীয় পুত্র অনঙ্গদেব সিংহের আমরা Direct বংশধর। সুতরাং রাজা বৈষ্ণব হলেও তার রাজত্ব এবং রাজসিংহাসন ও প্রজাগন কে রক্ষা করবার জন্যে, তিনি কোনো ভাবেই "যুদ্ধ" এবং "রক্তক্ষয়" থেকে দূরে থাকতে পারেন না। তাই যুদ্ধের দেবী মা মহিষাসুরমর্দিনীর সামনে রাজ পরম্পরার হেতু রক্তের আহুতি দিয়ে শক্তি, বাহুবল এবং বীরত্বের কামনা জানানো হয়।
তাই আমাদের বৈষ্ণব মতে পুজা হলেও নবমীর দিনে পশুবলির প্রথা আজও প্রচলিত রয়েছে।
অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য, হিন্দুশাস্ত্রে "দুর্গা" শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:-
‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই "দেবী দুর্গা"........
No comments:
Post a Comment