-অনুলিখন: বিজিৎ প্রশান্থা
বিজেপি এবং RSS এমন সংস্থান, যাদের বৌদ্ধিক গভীরতা খুবই কম এবং এদের মতাদর্শ একরকমের confused বামপন্থা। ঐতিহাসিকভাবে এই সংস্থানগুলি বিনায়ক সাভারকর, সীতারাম গোয়েল, অরুণ শৌরী-র মতো যুক্তিশীল হিন্দুত্ববাদী বক্তাদের দূরে সরিয়ে রাখার অভ্যেস বানিয়ে ফেলেছে। হাফ-প্যান্ট-বাদী এই সংস্থাগুলির মুখ্য সদস্যদের পড়াশোনা একেবারেই নগণ্য। এদের কাছে সমাজসেবামূলক কাজ মানে দু-চারজন হিন্দুদের ছেলেদের দিয়ে মসজিদ-গীর্জায় ঝাড়ু দেওয়ানো, মাইনরিটি মোর্চার নামে গ্রামের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করা, এবং 'অখন্ড ভারত' ও 'ভারতমাতা'-র মতো বোগাস এবং বিপজ্জনক ন্যারেটিভ বানানো।
'ভারতমাতা' এবং 'অখন্ড ভারত' শুনতে ভালো হলেও বিপজ্জনক, অ-হিন্দু ন্যারেটিভ কেন? এটা বুঝতে হলে আমাদের হিন্দুত্ব এবং সনাতন ধর্ম কী, তা academic-ভাবে বোঝা জরুরী। আব্রাহামিক মজহব-গুলিতে (খ্রীষ্টানিটি, ইসলাম, ইহুদী) ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান একটি entity মানা হয় যিনি আমাদের মাথার ওপর খুব উঁচুতে heaven-এ বসে আমাদের ক্রমাগত নিরীক্ষণ করে চলেছেন এবং আমাদের পাপ-পুণ্যের হিসেব রেখে চলেছেন। আব্রাহামিক ঈশ্বরের এইটুকু ব্যক্তিকেন্দ্রিক, physical আইডিয়াই হাজারটা puzzle বা ধাঁধা-র জন্ম দেয়। যেমন ধরুন:
1. যেহেতু পৃথিবী গোল, সুতরাং মাথার ওপর স্বর্গ এবং তাতে আসীন ঈশ্বর কী আসলে একটা ফাঁপা গোলকাকৃতি স্থান বা ব্যক্তি বিশেষ?
2. পৃথিবী ঘূর্ণায়মান, তাই মাথার ওপরের যে আকাশ তা তো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। তো ঈশ্বরও কী সময়ের সাথে সাথে অবস্থান বদলান?
3. ঈশ্বর যদি omnipotent হন, তাহলে এমন একটা পাথর কি তিনি বানাতে পারেন, যা তিনি নিজেই তুলতে অক্ষম?
-ইত্যাদি।
যাই হোক, আব্রাহামিক ধর্মগুলি তর্কের বদলে বিশ্বাসকে বাহুল্য দেয়, এসব স্বাভাবিক প্রশ্ন ও কৌতূহলকে ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে দমন করানোতেই মাথা খরচা করে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার: এই মজহব-গুলির ঈশ্বর কিন্তু মূল্যবোধের ধার ধারে না, উল্টে এদের মূল্যবোধ ঈশ্বরের থেকে সৃষ্ট হয়। আব্রাহামিক ঈশ্বরের যেহেতু সত্যনিষ্ঠা এবং মূল্যবোধের প্রতি নীতিগত দায়বদ্ধতা থাকে না, তাই এই মজহবগুলির মূল্যবোধগুলিরও সত্যনিষ্ঠার গ্যারান্টি খুব একটা থাকে না। বরং believer-nonbeliever, কাফের-মুমিন বাইনারিতে মানবতাকে আড়াআড়ি ভেঙে দেওয়া এই মজহবগুলিতে মূল্যবোধও অত্যন্ত পলিটিক্যাল হয়, সত্যনিষ্ঠ হয় না। এমনকী এই মজহবগুলি নিজেদের political expansion-এর সংকীর্ণ স্বার্থে 'সত্য'-এর সংজ্ঞাও বদলে ফেলে। এই ধর্মগুলির মতে: কুরআন বা বাইবেলে যা লেখা আছে, সেটাই সত্য। তা সে বইগুলি যা খুশি বলুক: পৃথিবী চ্যাপ্টা সমতল, পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে, সূর্যাস্তের পর সূর্য ঈশ্বরের তক্তার নীচে গিয়ে লুকিয়ে যায়- অর্থাৎ 'পবিত্র' বইতে যা লেখা আছে তাই সত্য।
হিন্দুধর্মে কিন্তু সত্য এবং সনাতন মূল্যবোধকে ঈশ্বরেরও উপরে স্থান দেওয়া হয়। এজন্যই বিষ্ণুর মতো দেবতাকে বৃন্দার মতো পতিব্রতা সাধারণ মানুষ অভিশাপ দিতে সক্ষম, আবার রাম-কৃষ্ণ-বুদ্ধের মতো সাধারণ জনগণও নিজ যোগ্যতায় ও কর্মবলে 'অবতার' আখ্যায়িত হয়। হিন্দুধর্মে একমাত্র সত্য-সনাতনই omnipotent ব্রহ্ম, অন্য কিছু নয়। এহেন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে যা কিছু প্রতীকের হিন্দুরা পূজা করে (মূর্তি, শিবলিঙ্গ, বৃক্ষ, শস্ত্র), সেই সবকিছুই সনাতন সত্য-সৃষ্ট মূল্যবোধেরই প্রতিভূ। এই সনাতনী প্রতীকগুলি সৃষ্টি এবং প্রচারের পেছনে আছে হাজার বছর ধরে ঋষি-মনীষী-পরম্পরা-জাত বিশদ শাস্ত্র, মন্ত্র ও তন্ত্রের সৃষ্টি চর্চা, ব্যাখ্যা এবং সত্যসন্ধান। সেজন্যই হিন্দুদের মূর্তিপূজা নিছকই পুতুলখেলা নয় - তা মন্ত্রোচ্চারণ-মনোসংযোগ-আত্মশুদ্ধি-সর্বকল্যাণকামনা-আত্মোপলব্ধির এক আধ্যাত্মিক সর্বাঙ্গীন অনুভূতি।
কিন্তু RSS-BJP যে ঘটা করে এত এত ভারতমাতি মন্দির বানাচ্ছে, এর আধ্যাত্মিক fundamentals কী? ভারতমাতা এবং অখন্ড ভারত তো পলিটিক্যাল, জমি-দখলের আইডিয়া। সময় বদলায়, ইতিহাস, ভূগোল, সীমানাও সাথে সাথে বদলায়, কিন্তু সনাতন ধর্ম তো বদলায় না! তাই 'ভারতমাতা' নামক কনসেপ্ট-এর না আছে সর্বময়তা, সারস্বত উপস্থিতি, না আছে হিন্দু শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা, না আছে মন্ত্রোচ্চারিত আধ্যাত্মিক নির্ঘোষ, না আছে আর্ষস্বীকৃতি - যা হিন্দু ঈশ্বরের আইডিয়ার পরিপন্থী। ভারতমাতা একটি hollow political concept যা হিন্দুধর্মচর্চার থেকে অনেক নীচুস্তরের একটি ভ্রষ্ট, অযৌক্তিক আইডিয়া। শুধু তাই নয়, RSS তাত্ত্বিকভাবে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এই ভারতমাতার প্রতি প্রেম-ভক্তি থেকে derive করে এসেছে। RSS-এর সত্যাদর্শ 'ভারতমাতা' নামক পলিটিক্যাল-ঈশ্বর-সম্ভূত। অর্থাৎ RSS-এর ভারতমাতা আসলে 'Abrahamic idolatry' বা একটি পলিটিক্যাল পুতুলের ইবাদত্-বাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
আর 'অখন্ড ভারত' তো আরো বিপজ্জনক একটি আইডিয়া। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মিলিয়ে নিলে অখন্ড ভারতে শান্তির সন্তানদের সংখ্যা দাঁড়ায় 75 কোটি। ভারতের হিন্দু জনসংখ্যা মেরেকেটে একশো কোটি। তার আবার ষাট কোটি ঘোরতর sickular। তো এমতাবস্থায় অখন্ড ভারতের একমাত্র অর্থ, 'শান্তিদূতদের সাথ, শান্তিদূতদের বিকাশ, এবং হিন্দুদের বিনাশ'।
এই উপমহাদেশের শান্তিদূতেদের সম্পূর্ণ ঘর-ফেরত না হওয়া অব্দি অখন্ড ভারতের সংস্থাপনা সম্ভব নয়। তবে লক্ষ্য করে দেখবেন, RSS-BJP-র ম্যানিফেস্টোতে আছে 'অখন্ড ভারত', - 'অখন্ড হিন্দুরাষ্ট্র' না।
তাই মরদ-এ-মুজা*হিদ মোদী এবং তার ইদানীং পাসমান্দা 'শান্তি'-প্রীতির সাতপ্যাঁচ দেখে মনে হয়: 'অখন্ড ভারতের' স্বার্থে হিন্দুত্বের সম্পূর্ণ বিনাশই BJP-RSS-এর মূল লক্ষ্য।
About us - আমাদের সম্পর্কে জানুন
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
সনাতন্ হিন্দু ধর্মে পবিত্র সংখ্যা ১০৮ এত মহাত্মপূর্ণ কেন...???
সনাতন্ বৈদিক হিন্দু ধর্মে, ১০৮ সংখ্যা টি অত্যন্ত পবিত্র সংখ্যা রূপে গণ্য করা হয়। কিন্তু কেন...??? কলমে :- অরিন্দম রায়। আমাদের যো...
-
লিখন: বিজিৎ প্রশান্থা সম্প্রতি এক উঁচুস্তরের দিল্লী মহলের নেতা JNU -এর এক হিন্দুবাদী প্রফেসর আনন্দ রঙ্গনাথনের কাছে নাকি এই অভিমত ব্যক্ত কর...
-
-অনুলিখন: বিজিৎ প্রশান্থা নরেন্দ্র মোদীর মন্দির বিধ্বংস করার রাজনীতির শুরু হয় সম্ভবত ২০০৮ সালে, যখন সড়ক সম্প্রসারণের দোহাই দিয়ে তার সরকার...
-
সনাতন ধর্ম এবং সভ্যতা কত পুরাতন...?? রচনা :- অরিন্দম রায়। "সনাতন বৈদিক ধর্ম ও সভ্যতা মাত্র ৫০০০ বছর পুরাতন হতে....." :- এমনটি ...
No comments:
Post a Comment