Thursday, October 26, 2023

কমিউনিজম

লিখন: বিজিৎ প্রশান্থা

এই পোস্টটিতে আমি ভারতীয়তার মতো একটি all-inclusive ধারণার প্রেক্ষিতে বামপন্থার মত একটি বাইনারি ধারণার অসারতা নিয়ে লিখছি, যাতে পরের বছর এলিট বাঙালিরা ওয়াইন চাটতে চাটতে 'আমি বামপন্থী'-জাতীয় স্লোগান দেবার আগে একটু ভেবে দেখার সুযোগ পান যে এই রক্তবীজের ঝাড় আমাদের রাজ‍্যের কতদূর সর্বনাশ করার ক্ষমতা রাখে এবং পরের বছর নির্বাচনে এদের বিলুপ্তি বাঙালিদের জন‍্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো- মূলতত্ত্ব:
কমিউনিজম এমনই একটি বাইনারি আইডিয়া যেখানে মানবসভ‍্যতার ইতিহাসকে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস হিসাবে তত্ত্বায়িত করা হয়েছে। কমিউনিজম যেকোনো সমাজকে আড়াআড়ি দুটি সম্প্রদায়ে বিভাজিত করে, বুর্জোয়া বা অভিজাত এবং প্রলেতারিয়েৎ অর্থাৎ (মূলতঃ) শ্রমজীবী। কমিউনিজমের মতে বুর্জোয়া মূলতঃ সুবিধাভোগী সম্প্রদায় যারা প্রলেতারিয়েতের শ্রমলব্ধ উৎপাদন এবং সম্পদ বে-লাগামভাবে উপভোগ করে এবং এজন‍্য যেন-তেন-প্রকারেন রাজনৈতিক এবং আর্থিক ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত রাখতে চায়। ফলতঃ প্রলেতারিয়েৎ সম্প্রদায় তাদের শ্রমের প্রাপ‍্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং ক্রমশঃ সর্বহারা একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। এরই প্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট ম‍্যানিফেস্টো দুনিয়ার সমস্ত মজুরদের এক হয়ে একটি শ্রেণীসংগ্রামের সূচনা করতে বলে।

এই ম‍্যানিফেস্টোর একটি আপাত আদর্শবাদ আছে যা শ্রমিকদরদী এবং গরীবদরদী যেকোনো মানুষকে আকৃষ্ট করতে বাধ‍্য। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এই মতবাদটির অসারতা, অসংগতি, এবং বিপজ্জনক সম্ভাবনা উপলব্ধি করা যায়।

ক. দ্বিত্বতা:
কমিউনিজম একটি বাইনারি অর্থাৎ দ্বিত্ববাদ। এই মতবাদ সমাজকে দুটি শ্রেণীতে ভেঙে ফেলে। এবং তা করতে গিয়ে কমিউনিজম সেই সমাজের অার্থিক, রাজনৈতিক এবং চিন্তাধারার স্পেকট্রাম এবং বিভিন্নতা অস্বীকার করে। সমাজের সাংস্কৃতিক বিবিধতা, বিভিন্ন অংশের মানুষের ব‍্যক্তিগত স্তরে সম্পর্ক, রীতি-রেওয়াজ, এমনকী একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতা- কমিউনিজম এর কোনোটিরই পরোয়া করে না। সুতরাং, মানুষকে সাদা-কালোয় বিভাজিত করার এই মতবাদ একটি বহুত্ববাদী সমাজের আদর্শ হতে পারে না। 'বিবিধের মাঝে মহান মিলনের' যে মন্ত্র, কমিউনিজম তা স্বীকার করে না।

খ. লঙ্ঘিত সার্বভৌমত্ব:
কমিউনিস্ট ম‍্যানিফেস্টোর দ্বিতীয় অধ‍্যায়ে লেখা আছে, "In the national struggles of the proletarians of the different countries, they point out and bring to the front the common interests of the entire proletariat, independently of all nationality." আপাতভাবে আদর্শবাদী মনে হলেও বর্তমান দুনিয়ায়, যেখানে প্রতিটি দেশের স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, এই ধরনের চিন্তাধারার যৌক্তিকতা প্রশ্নাতীত নয়। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কমিউনিজম অবলম্বন করার প্রেক্ষিতে এই সুপ্ত দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক অশান্তির জন্ম দিয়েছে, রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলি (এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ‍্য) যার জ্বলন্ত সাক্ষী। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার প্রাক্কালে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি (পড়ুন: গঙ্গাধর অধিকারী থিসিস) ভারতবর্ষকে দুই বা তিন নয়, সতেরটি খন্ডে ভাগ করার প্রস্তাব পেশ করে। আপনারা অনুমান করতেই পারেন, ভারতীয় ভূখন্ড সতেরটি খন্ডে ভেঙে গেলে তা এই উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার পক্ষে কতটা বিপজ্জনক হত এবং আজ পর্যন্ত ভারতের কোনো বামপন্থী দল এই 'অধিকারী থিসিস' খন্ডন করেননি বা এর প্রকাশ‍্যে মতবিরোধ করেননি!

গ. অবাঞ্ছিত বিভাজন এবং পার্টিসর্বস্বতা:
যেহেতু এই কমিউনিস্ট অ‍্যাজেন্ডা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো একটি রাজনৈতিক পার্টি দ্বারা পরিচালিত হয়, তাই এই বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েৎ বিভাজন মূলতঃ কমিউনিস্ট -নন-কমিউনিস্ট বিভাজন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ যে শ্রেণীগত বিভাজনের অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোনো কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু হয়, তা ক্রমশঃ একটি রাজনৈতিক দলগত বিভাজন হয়ে পড়ে। দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর মতো একটি আদর্শবাদী ধারণা ধীরে ধীরে পার্টিসর্বস্ব কার্যকলাপে পর্যবসিত হয়।

ঘ. কাঁকড়া-প্রব‍ৃত্তি (crab mentality):
কমিউনিজমের মূল ধারণা শ্রেণীসংগ্রাম যা একটি সমাজে শ্রেণীবিদ্বেষ সৃষ্টি করতে বাধ‍্য। সমাজের তথাকথিত উপরতলার মানুষের সাথে তথাকথিত নীচুতলার মানুষের প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব এবং লড়াইয়ের পটভূমিতেই কমিউনিজমের ফুলে-ফলে বিকাশ ঘটে। কিন্তু এই সামাজিক লড়াই সমাজের সামূহিক বৃদ্ধি ব‍্যাহত করে। কমিউনিজম আদতে একটি কাঁকড়ার মানসিকতা যা নিজেকেও এগোতে দেয় না, উপরন্তু অন‍্য কেউ এগোতে চাইলে তাকেও টেনে নামায় (if I can't have it, neither can you)। কমিউনিজম না 'বুর্জোয়া' গোষ্ঠীকে উৎপাদন বাড়াতে অনুপ্রেরণা দেয়, না 'প্রলেতারিয়েৎ'-দের ব‍্যক্তিগত বিকাশের সুযোগ দেয়। সুতরাং কমিউনিজম যোগ‍্যতাতন্ত্র এবং গুণতন্ত্রের প্রবল বিরোধী একটি মতবাদ।

ঙ. কুক্ষিগত সম্পদ:
কমিউনিজমের আর একটি ধারনা ব‍্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ:

"In this sense, the theory of the Communists may be summed up in the single sentence: Abolition of private property." - Communist Manifesto

কমিউনিস্টরা এই ধারনাটির প্রয়োগ করতে গিয়ে তর্কাতীতভাবে ছড়িয়েছে। সম্পত্তির সরকারিকরন যেমন একদিকে সম্পদের সার্বিক বৃদ্ধি ব‍্যাহত করেছে, তেমনই মানুষের স্বকীয়তাকে (individuality) পরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করেছে। এবং এর মাধ‍্যমে কমিউনিজমের সুবিধেই হয়েছে কারণ কমিউনিস্ট দেশগুলি নিজেদের দারিদ্র‍্যের জন‍্য উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিকে দোষারোপ করতে পেরেছে এবং এ যে এক বৃহত্তর শ্রেণীসংগ্রাম- এই ধারণা তুলে ধরে মানুষকে হগওয়াশ করতে পেরেছে। সম্পদই সম্পদ সৃষ্টি করে এবং মুক্ত বাজার সম্পদের আঞ্চলিক বৈষম‍্য ঘোচাতে পারে। অন‍্যদিকে সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে আষাঢ়ে আইন দ্বারা বাজার-নিয়ন্ত্রণ না বুর্জোয়ার মঙ্গলসাধন করে, না প্রলেতারিয়েতের। এখানে পাঠক বলতে পারেন, মুক্ত বাজারে কোনো বিশেষ একটি সম্পদে কোনো বিশেষ একটি কোম্পানির মনোপলি বা একাধিপত‍্যের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে 'মুক্ত বাজার বৈষম‍্য কমায়' জাতীয় কথাবার্তা কতটা যুক্তিযুক্ত? এপ্রসঙ্গে বলে রাখি, পরিস্থিতির হিসেবে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা আমি করছি না। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদে, এমনকী তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ‍্যত নির্ধারণে সরকারের মনোপলির আমি ঘোর বিরোধী।

চ. ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিলোপ:
কমিউনিস্টরা এই 'abolition of private property' যুক্তিটিকে একরকম অসভ‍্য পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাঁদের মতে, যেহেতু এই সমাজ (মানে যেকোনো সমাজ যা কমিউনিস্টদের কব্জাগত নয় আর কী!) গুণগতভাবে বুর্জোয়া সমাজ, তাই এখানে অতীতই বর্তমানকে শাসন করে। সুতরাং এই সমাজের যা কিছ অতীত এবং যা কিছু উত্তরাধিকার, কমিউনিজম সেই সমস্ত কিছু বিলোপ এবং ধ্বংস করার কথা বলে। কমিউনিজম এভাবে সমস্ত জাতির সাংস্কৃতিক ধ্বংস-সাধনের পক্ষে কথা বলে। এই ধারনাটি কতটা বিপজ্জনক, তা বর্তমান যুগে চীনা সরকার কর্তৃক সাধিত উইগুর মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বিনাশের কর্মকান্ড দেখলেই বোঝা যায়। প্রসঙ্গতঃ, মধ‍্যপ্রাচ‍্যের মুসলিম সংস্কৃতি ধ্বংসের স্বার্থে রাশিয়ার কর্মকান্ডও এখানে স্মর্তব‍্য।

ছ. প্রপাগ‍্যান্ডা:
সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের শিক্ষাব‍্যবস্থায় বামপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ভারতীয়তার মূলস্রোত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়াস করেছে। যে মাও-সে-দঙ চীনে লক্ষ লক্ষ নরসংহার করেছে, যে মাও-সে-দঙের নেতৃত্বে চীন ভারতকে উনিশশো বাষট্টিতে আক্রমণ করে ভারতের মাটি কব্জা করে নিয়েছে, সেই মাও-য়ের প্রশস্তি আমি অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস বইতে পড়েছি। ভারতীয় ইতিহাসকে বিকৃত করার এই যে প্রয়াস, তা যে আসলে কমিউনিস্ট প্রপাগ‍্যান্ডা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

জ. কমিউনিস্ট সমাজের পরিণতি:
এখন তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, কমিউনিজম সর্বহারাদের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে ভাবে এবং সমাজে সাম‍্য আনার জন‍্য প্রতিনিয়ত আন্দোলন করে যায়, তাহলে আমরা এই নিখিল বিশ্বে তো একটা উদাহরণ খুঁজে পাব যেখানে কমিউনিজম বিদ‍্যমান, মানুষ ধনবান, সমাজে সমতা আছে এবং সব মানুষের মত প্রকাশের মুক্ত অধিকার আছে। কিন্তু নাহ্! ইতিহাস ভূগোল সব ঘেঁটে একটি উদাহরণও কেউ খুঁজে পাবে না যেখানে কমিউনিজম তার প্রতিশ্রুত ইউটোপিয়া জনগণকে ডেলিভার করেছে। মানুষ মূলতঃ একটি ক্ষমতালোভী প্রজাতি এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই কমিউনিজমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মানুষ সব ক্ষমতা এবং অধিকার কুক্ষিগত করে হয় মানুষের মগজধোলাই করেছে, নয়তো বঞ্চনা, দারিদ্র্য, হিংসা, গৃহযুদ্ধ, গণহত‍্যার দিকে মানুষকে ঠেলে দিয়েছে।

ঝ. পশ্চিমবঙ্গ এবং কমিউনিজম:
কমিউনিজমের সারকথা: 'লড়াই লড়াই লড়াই চাই'। এবং সমাজে এই লড়াই, বিভেদ, যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে কমিউনিস্টরা যে কোনোরকমের শয়তানিতে সিদ্ধহস্ত। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই, তথাকথিত বামপন্থী দলগুলি পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ‍্যটির কী অপরিসীম সর্বনাশ করেছে! ভোটের লোভে অবাধে অনুপ্রবেশ করিয়েছে, শিক্ষাব‍্যবস্হায় মধ‍্যমেধাকে প্রাধান‍্য দিয়ে উঁচুপদগুলিতে পার্টি-ক‍্যাডারদের বসিয়েছে, বঙ্গসংস্কৃতির যথেচ্ছ বিকৃতি করেছে, দেশবিরোধী বাইরের শক্তিগুলির সাথে হাত মিলিয়েছে, বামবিরোধী মানুষদের অবাধে হত‍্যা করেছে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে ফেলেছে ইত‍্যাদি।

ভারতের প্রেক্ষিতে কমিউনিজম:
ভারতের মতো একটি দেশ যা মোটের ওপর শান্তিপ্রিয়, সর্বংসহ এবং যে দেশ যুগ-যুগান্ত ধরে সর্ব-পন্থা-সমন্বয়ের জয়গান গেয়ে চলেছে, সেখানে কমিউনিজমের মত একটি চতুর, দ্বিত্ববাদী, ধ্বংসাত্মক মতবাদ না থাকলেও খুব একটা ক্ষতি হবে না। আমাদের সমাজকে অবশ‍্যই আরও বেশী মানবদরদী হতে হবে, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন‍্য আমাদের অবশ‍্যই লড়ে যেতে হবে, কিন্তু তার জন‍্য কমিউনিজমের হাত ধরার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

বাঁচুন। বাঁচতে দিন। কমিউনিজম এড়িয়ে চলুন।: কমিউনিজম ধর্মের মতোই এক আফিম। মানুষকে ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখায়। দলবদ্ধ হতে বলে। সাম‍্যের জন‍্য লড়াই করতে বলে। কালক্রমে বর্গবিদ্বেষ মাথাচাড়া দেয়। কমিউনিস্টরা ক্ষমতাসীন হয়। এবং ধীরে ধীরে একটি সমাজের ঐক‍্য, সম্প্রীতি, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক নিজস্বতা সমস্ত কিছু নির্মমভাবে ধ্বংস করে ফেলে।

তাই মানুষের মত মানুষ হোন। শিক্ষিত, বিবেচক, সহমর্মী হোন। এই গুণগুলির অভ‍্যাস করতে হলে কমিউনিস্ট হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

No comments:

Post a Comment

সনাতন্ হিন্দু ধর্মে পবিত্র সংখ্যা ১০৮ এত মহাত্মপূর্ণ কেন...???

সনাতন্ বৈদিক হিন্দু ধর্মে, ১০৮ সংখ্যা টি অত্যন্ত পবিত্র সংখ্যা রূপে গণ্য করা হয়। কিন্তু কেন...??? কলমে :- অরিন্দম রায়। আমাদের যো...