Thursday, October 26, 2023

হিন্দুত্ব without বিজেপি এবং একম সনাতন ভারত

লিখন: বিজিৎ প্রশান্থা

সম্প্রতি এক উঁচুস্তরের দিল্লী মহলের নেতা JNU -এর এক হিন্দুবাদী প্রফেসর আনন্দ রঙ্গনাথনের কাছে নাকি এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে [১], এই হিন্দু-মুসলিম আগুন যত লেগে থাকবে, বিজেপি-র পক্ষে ততই মঙ্গল। ড: রঙ্গনাথনের এই হাটে-হাঁড়ি-ভাঙা বক্তব্য যে সত্যি,- মানে বিজেপি যে এটাই চায়- তা নিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের কোনো নাগরিকেরই কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু একটা স্বার্থপর, সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন : এই আগুনে কে জ্বলছে,আর কে আঁচ পোহাচ্ছে? বিজেপির পলিটিক্সে যদি হিন্দুত্বের লাভ হয়ে থাকে, তাহলে স্বার্থপর,সাম্প্রদায়িক, গর্বিত হিন্দু হিসেবে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? বিজেপি কি সত্যিই হিন্দুত্ববাদী পার্টি? বিজেপি নেতারা কি সত্যিই হিন্দুত্বের জন্য, হিন্দুত্বের হয়ে, হিন্দু হিসেবে লড়ে? এই যে জি*হাদি শক্তিগুলোর সামনে হিন্দু বাঙালিকে আগের চেয়েও বেশি অসহায় দেখায়, এটা কি হিন্দুদের চরম আত্মবিশ্বাসহীনতা, নাকি এটা বিজেপি হাই-কম্যান্ড-এর পূর্ব-পরিকল্পিত, সাজানো ব্যর্থতা - যাতে বিজেপি হিন্দু-লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ফোবিয়ার রাজনীতি করতে পারে এই বলে যে, 'বিজেপি-কে ভোট দাও নয়তো তোমাদের বাকি সবাই মেরে ফেলবে'? সর্বোপরি, হিন্দুরাষ্ট্র নামক খুড়োর কলে অসংগঠিত হিন্দু সমাজকে টাঙ্গিয়ে, সারাক্ষন গণ-মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম চেঁচিয়ে বিজেপি নেতারা যে হিন্দুদের কাছে হিন্দুত্ববাদের স্বার্থে ভোটের জন্য আবদার করে, বিজেপি সেই হিন্দুত্ববাদের বিষয়ে কতটা আন্তরিক?

'তুষ্টিকরণ' নয়, 'তৃপ্তিকরণ' রাজনীতি:

২০১৪-এ মোদির স্লোগান ছিল 'সবার বিকাশ, তুষ্টিকরণ কারো নয়'। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ লোকসভা জেতার পর ঘোষণা করেন, এবার 'তুষ্টিকরণ' রাজনীতির দিন শেষ এবং 'তৃপ্তিকরণ' রাজনীতির শুরু। নরেন্দ্র মোদী নতুন নতুন শব্দাবলী চয়ন করার জন্য গোবলয় রাজ্যগুলিতে সুপ্রসিদ্ধ। কিন্তু এই তৃপ্তিকরণ রাজনীতির পরিসংখ্যান, বলা বাহুল্য, খুবই ভয়াবহ। ২০১৯-এর স্লোগান বিজেপি-র পূর্ব সংখ্যালঘু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাকভি-র গলাতেও বেশ দৃপ্তভাবে শোনা যায় [২]: 'কংগ্রেস ৭০ বছরে মুসলিমদের জন্য যা করেনি, মোদী ৭ বছরে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ মুসলিমদের জন্য করে দিয়েছে'। কারণ:

ক) কংগ্রেস যদি সত্তর বছরে টোটাল ৩ কোটি মুসলিমদের ছাত্রবৃত্তি দিয়ে থাকে, তাহলে বিজেপি সাত বছরে পাঁচ কোটিরও বেশী মুসলিমদের স্কলারশিপ দিয়েছে।

খ) টেকনিকাল চাকরি কংগ্রেস যদি ২০০০০ মুসলিমদের দিয়ে থাকে, তাহলে বিজেপি সাড়ে-২১ লক্ষ মুসলিমদের দিয়েছে।

গ) কংগ্রেস জমানায় মাত্র ৫% মুসলিম সরকারি চাকরি পেয়েছিল, সাত সালেই এই হার ১০% পৌঁছে গেছে।

ঘ) টোটাল জনসংখ্যার মাত্র ১৫% হওয়া সত্ত্বেও মোদী ৩৭-৩৮% কেন্দ্রীয় সম্পদে মুসলিমদের অধিকার দিয়ে ফেলেছে, যদিও এই বিশাল পরিমাণ অসামঞ্জস্যতা আসলে হিন্দু দলিত এবং জনজাতি সমাজকে ক্রমশ পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।

ঙ) বর্তমানে মোদী সরকার মুসলিমদের জন্য প্রকাশ্যে কয়েক ডজন প্রকল্প চালাচ্ছে: 'নিকাহ শগুন', 'হুনর হাট', মাদ্রাসা অনুদান, হজ হাউস, ছাত্রবৃত্তি, মুফত IAS কোচিং, মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়,'নয়ি মঞ্জিল', 'নয়ি উড়ান', 'নয়ি রোশনি', 'নয়া সবেরা', 'গরীব নাওয়াজ', সস্তা দেনা, 'পড়ো পরদেশ' ইত্যাদি। কিন্তু মোদির চালানো 'হিন্দু'-স্পেসিফিক প্রকল্প, যা শুধুমাত্র হিন্দু পরিচয়ের ভিত্তিতে দেওয়া হয়,- এর সংখ্যা শূন্য।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-এর লঘুকরণ:

নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম বড় কীর্তি হলো গুজরাটে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দাপট লাঘব করা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হবার সুবাদে হিন্দুদের রাজনীতি-ব্যতিরেকে একত্রিত করতে প্রচেষ্ট ছিল। এর প্রমাণ ছিলেন স্বয়ং প্রবীন তোগাড়িয়া, যার অরাজনৈতিক জনসভায় যেকোনো বিজেপি নেতার চেয়ে বেশী ভীড় হতো এবং যার দাপটে ইসলামিক মৌলবাদী শক্তিগুলি গুজরাটে মাথাচাড়া দিতে পারতো না। মোদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-এর মতো অরাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে বিজেপি-এর দলদাসে পরিণত করে ফেলে, যারা কালক্রমে বিজেপি-এর ভোট জোগাড় করার যন্ত্রে পরিণত হয় এবং স্বতন্ত্র হিন্দুকণ্ঠ হারিয়ে ফেলে। পরিণামস্বরূপ, মোদীর দশ বছরের কেন্দ্রীয় শাসনে হিন্দুরা বিজেপির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং স্বতন্ত্র হিন্দু ইস্যুগুলি বিজেপির পলিটিক্স-এর আবর্তে তলিয়ে যায়। তাই যখন আজকাল গুজরাটে রামনবমীতে ভয়ঙ্কর দাঙ্গার খবর আসে, আমরা আর অতটাও আশ্চর্য হই না।

আবার অন্যদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-কে মোদীর মুসলিম তৃপ্তিকরণ বা হিন্দুত্ব-বিরোধী পলিসি-গুলিতে যেভাবে চুপ থাকতে দেখা যায়, তাতে নিঃসন্দেহে মনে হয় বিজেপি-আরএসএস-VHP ত্রয়ী সংস্থানগুলি বিরোধী দল হিসেবেই হিন্দুত্বের পক্ষে ভালো কাজ করে, - কিন্তু শাসক দল হিসেবে এদের চেয়ে বড় হিন্দু-ঘাতক সংস্থান আর কিছু নেই।

'ভাজপা-র মানে ভগবা নয়':

বিজেপির অধ্যক্ষ জেপি নাড্ডা কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করে যে, ভাজপা আর ভগবা এক নয়। বস্তুত এই হিন্দুত্ববাদ-সেক্যুলারিজম দ্বৈততাই বিজেপি-র রাজনীতির মূল রেসিপি। এজন্যই এরা জেনেবুঝে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে একজন সেক্যুলার নেতা বসিয়ে রেখে রাজ্য লেভেলে রেখেঢেকে হিন্দুত্ব রাজনীতি করে। তাই তো কেন্দ্রে যখন 'সেক্যুলার' বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকে, তখন 'হিন্দুবাদী' আডবাণী,মোদী-আদি নেতারা রথযাত্রায় বেরোয়। আবার কেন্দ্রে যখন 'সেক্যুলার' মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে চলে আসে, তখন উত্তরপ্রদেশে গেরুয়াবস্ত্র-ধারী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে হিন্দুত্বের নাটক শুরু করে দেয়।

বিজেপি-র এই 'জলে-নামবো-কিন্তু-বেণী-ভেজাবো-না'-বাদী হিন্দুত্ব রাজনীতি আসলে প্রমাণ করে যে বিজেপি হিন্দুত্ববাদ নিয়ে আসলে অতটাও গম্ভীর নয় যতটা কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-ইসলামিস্ট আঁতাত দাবি করে। এর মূল কারণ বিজেপি নামক সংস্থাটির প্রতিষ্ঠার গোড়া থেকেই নীতিগতভাবে বড় গলদ রয়ে গেছে। বিজেপি-র নিজস্ব বুদ্ধিজীবী কোষ (intellectual cell) বলে কিছু নেই, এদের নিজস্ব স্বদেশী বাস্তুতন্ত্র (eco-system) সম্পূর্ণ বায়বীয়, এদের অর্থনৈতিক মতাদর্শের সাহিত্যের মূল কথা গান্ধীবাদী সমাজবাদ (Gandhian Socialism) যা স্বয়ং কংগ্রেসও বিশ বছর আগে ত্যাগ করেছে , এদের হিন্দুত্ব 'ভারতমাতা', 'অখন্ড ভারত', 'সব ভারতবাসীই হিন্দু', 'One Nation One Religion' - এসব ফালতু gimmick-এ আটকে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর ক্রম-পরিবর্তনীয় narrative-এর যুগে বিজেপি-র এই মান্ধাতা হিন্দুত্ববাদ সমর্থন করা হিন্দুদের জন্য বোকামো নয় - বরং বিপজ্জনক। কারণ এরকম হিন্দুত্ববাদ হিন্দু ধর্মের মৌলিক অবধারণাগুলি থেকে দূরে করে হিন্দুদের ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকে বামপন্থী কংগ্রেস-কমিউনিস্টদের ক্রমাগত অবমাননা সহ্য করার পরই হিন্দু সমাজ খেটেখুটে যখন বিশ্বমঞ্চে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করছে, যখন ব্রিটিশ-দের নির্মিত বিষাক্ত জাতিবাদের ওপরে উঠে একত্রিত হয়ে দিল্লির মসনদের সামনে স্বাভিমান, সম্মান এবং অধিকার দাবি করছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে একরকম ষড়যন্ত্র করেই বিজেপি Ambedkarite আন্দোলন খাড়া করে হিন্দুত্ব থেকে দলিত সমাজকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করছে, টিভি চ্যানেল-এ চরম মৌলবাদী AIMIM দলের সদস্যদের জায়গা দিয়ে মুসলিমদের মৌলবাদের শিক্ষা দিচ্ছে এবং একই সাথে হিন্দু সমাজে ভীতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

তাই জেপি নাড্ডাকে উদ্ধৃত করেই বলা যায়, বিজেপি মানেই ভগবা নয়। বরং ঐতিহাসিকভাবে বিজেপি ভগবা ইস্যুগুলি থেকে নিজেদের শত যোজন দূরে সরিয়ে রেখেছে। বিজেপি আসলে চায় যে, হিন্দু সমাজ হয় বিজেপির অনুগত এবং নমনীয় থাকুক,- নয়তো বিজেপি-কর্তৃত্ব-বিরোধী হলে একান্তই দুর্বল থাকুক। শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ হিন্দুত্ববাদ কংগ্রেসের পক্ষে যতটা অবাঞ্ছনীয়, বিজেপি-র কাছে ততটাই পরিত্যাজ্য।

'One Nation One Religion' তত্ত্ব:

PPSSC (পরম পূজ্য সার-সংঘ চালক) মহান ভাগবতের মতো কিছু 'দরকারি', 'দরবারি' গর্দভের মাধ্যমে বিজেপি বেশ কয়েক বছর ধরে সনাতনী হিন্দুত্বকে বিকৃত এবং অপসারণ করে সংঘি হিন্দুত্ব আমদানি করার চেষ্টা করছে। এর মূল লক্ষ্য হলো হিন্দুত্বকে শরিয়া-অনুগত করা, যাতে 'One Nation One Religion'-এর মতো দিবাস্বপ্নবাদী আদর্শ ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করা যায়। ভাগবত এপ্রসঙ্গে সম্প্রতি ‘One DNA theory’ নামক আর একটি বায়বীয় তত্ত্বের প্রবর্তন করেন, যার মূল কথা যে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কেবল মরীচিকা নয় কারণ হিন্দু এবং মুসলিমদের DNA এক। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, মোদীর 'তৃপ্তিকরণ' রাজনীতির দরুন ভাগবত আশরাফ-মুল্লা-মুফতি সমাজকে ই*সলামিক সাহিত্যে আজ্ঞাপিত জি*হাদি, হিংস্র মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন করে না, ই*সলামের মূর্তি-ভাঙার 'আধ্যাত্মিক' প্রথা নিয়ে আওয়াজ তুলতে পারে না, মূর্তিপূজকদের প্রতি কো*রানে আদিষ্ট ঘৃণার ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলে পারে না, অমানবিক শরিয়া আইন-কানুন নিয়ে তর্ক করতে পারে না। মোহন ভাগবত শুধু হিন্দুদেরই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করতে ওস্তাদ: হিন্দুদের কেন মূর্তিপূজা করা উচিত নয়, হিন্দু সেনাপতি হংস এবং ডিম্বক কি আসলে সমকামী ছিলেন, কেন হিন্দুদের জ্ঞানবাপী এবং বাকি কনভার্টেড মন্দিরগুলি থেকে দাবিদাওয়া ছেড়ে দেওয়া উচিত, ইত্যাদি!

এই চরম 'পবিত্র' One DNA ঐক্যের ঠেলায় বিজেপি যা-কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী মতাদর্শী, - জি*হাদি, কমিউনিস্ট, আজাদী activist, বহুজনবাদী, নব-বুদ্ধিস্ট,আম্বেদকরবাদী, খালিস্তানি - সবাইকেই বাকস্বাধীনতার অধিকার দিতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু নুপুর শর্মা বা টি রাজা সিং যখন ই*সলামিক সাহিত্য থেকেই লাইন উদ্ধৃত করে ই*সলামের সত্য জনসমক্ষে আনেন, তখন এদের মৌলবাদী নেকড়েদের মুখে ছুঁড়ে দিতে বিজেপি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।

বরং, যখন 'সার তান সে জুদা' হুমকি ছুঁড়ে দেওয়া ধর্মান্ধ জনতা ভারতের রাস্তাগুলিতে ভিড় করেছিল, যখন নূপুর শর্মার কুশপুত্তলিকাকে অপমান করে রাস্তায় পোড়ানো হয়েছিল, যখন বিজেপির নিজস্ব সংখ্যালঘু মোর্চার সদস্যরা এবং আজমীর দরগার খাদিমরা পরিকল্পনা করে কানহাইয়া লালের গলা কেটে ফেলে (কথিত আছে, আজমিরের একজন খাদিম,- গওহর চিস্তি, আজমীর দরগায় কানহাইয়া লালের খুনিদের একজনের সঙ্গে দেখা করে। গওহর বিজেপির প্রাক্তন মুখপাত্র নুপুর শর্মাকে 'ব্লাসফেমি' করার অভিযোগে শিরশ্ছেদের ডাক দিয়েছিল), যখন নূপুর শর্মার সমর্থনে এগিয়ে আসার 'অপরাধে' বজরং দলের সদস্য হর্ষ হিন্দুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছিল- তখন 'হিন্দু-হৃদয়-সম্রাট' মোদি নীরবতাই বেছে নিয়েছিলেন.. বরং তিনি আজমীর দরগায় চাদর পাঠিয়ে ধর্মান্ধ খাদিমদের এই 'সাহসী' কর্মকাণ্ড সানন্দে উদযাপন করেছিলেন।

যখন ধর্মান্তরণের নোংরা উদ্দেশ্য নিয়ে দরগার 'চাদর' এবং গীর্জার 'ফাদার' ভারতের প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে, এবং Covid-এর করাল গ্রাসে ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত গ্রামীণ রাজনীতির সুযোগ নিয়ে মৌলবী আর খ্রীষ্টান যাজকরা বিদেশী ফান্ডিং-এর জোরে গ্রামের সিধেসাধা হিন্দুদের সবার প্রকাশ্যে ধর্মান্তরিত করছে, এবং অপ্রয়োজনীয় বর্ণবিদ্বেষ, হিংসা, অস্থিরতা ও অশান্তির অন্ধকার গর্ভে ভারতীয় গ্রামীণ সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে - তখন মোদী এবং বিজেপি এই সমস্ত বিষয়েই অদ্ভুতভাবে নীরব। এমনকি ধর্মান্তরণ রেকেট-এর বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে লড়াই করে নিহত বিজেপি কর্মীদের থেকেও বিজেপি হাইকমান্ড নিজেদের নিষ্ঠুরভাবে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। হিন্দুদের সাথে এরকম বিমাতৃসুলভ আচরণ বিজেপির শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের নজর এড়াচ্ছে না।

মন্দির-ধ্বংসের কর্মকান্ড:

নরেন্দ্র মোদীর মন্দির বিধ্বংস করার রাজনীতির শুরু হয় সম্ভবত ২০০৮ সালে, যখন সড়ক সম্প্রসারণের দোহাই দিয়ে তার সরকার গান্ধীনগরে ৮০-খানা মন্দির ধ্বস্ত করে ফেলে [৩]। স্বাধীন ভারতে কোনো সরকারি কর্মকান্ড এতো বড় দুঃসাহস দেখাতে পারেনি। এই প্রজেক্টের ফলে হিন্দু ধর্মস্থান বিনাশের প্রতিযোগিতায় মোদী এক ঝটকায় কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টিদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে যায়।

বিজেপি কর্নাটকে আসার পর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১-এর মধ্যেই ২৬০০ মন্দির ধ্বংস করে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ না এলে বিজেপির কর্নাটকে আরো ৬৫০০ মন্দির ধ্বংস করার পরিকল্পনা ছিল [৪]। কর্নাটকে এই রেকর্ড টিপু সুলতানের আছে কিনা সন্দেহ।

কাশী বিশ্বনাথ করিডোর বানাতে কয়েক ডজন সুপ্রাচীন মন্দির ধ্বংস করা হয়। বিশ্বেশ্বর শিবের দর্শন করার পথে পঞ্চায়তন ঈশ্বর - গণেশ, দুর্গা, শিব, বিষ্ণু, সূর্য - এই পাঁচ ভগবানের মন্দির দর্শন করা মঙ্গল মনে করা হত। এই পাঁচ মন্দির পরিক্রমা ছাড়া কাশী বিশ্বনাথ দর্শন অসম্পূর্ণ মনে করা হতো। মোদির কাশী করিডোর এই পাঁচটি মন্দিরকেই নির্মমভাবে ধস্ত করে দেয় [৫]। কাশী সংকট-মোচন মন্দিরের পুরোহিত এবং IIT বারাণসীর ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান বিশ্বম্বর নাথ মিশ্রের মতে, হিন্দু পুরাণে কাশী বিশ্বেশ্বর মন্দিরের আশেপাশে ১৪৩টি অতি পবিত্র স্থল ছিল, যার কোনো পরোয়া মোদী করেনি এবং করিডোর বানিয়ে এই ১৪৩টি স্থল করিডোর পরিসর থেকে সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে ফেলা হয়। হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী, ৮৪ রকমের তীর্থযাত্রা ব্যাসপীঠে সমাপন হতো যা বিশ্বেশ্বরের নন্দী মহারাজ থেকে কিছু দূরেই অবস্থিত ছিল। মোদী এই ব্যাসপীঠ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও মূল মন্দিরের আশেপাশে অসংখ্য শিবলিঙ্গ ছিল, যেগুলি নির্মমভাবে উৎখাত করা হয় এবং কিছু দূরেই নোংরা নর্দমায় ফেলে দেওয়া হয়।

অযোধ্যার পবিত্র রাম মন্দির নির্মাণকালে মোদী-যোগীর ডাবল-ইঞ্জিন উত্তরপ্রদেশ সরকার রামায়ণ-এর কাহিনীর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত কয়েক ডজন অত্যন্ত সুপ্রাচীন মন্দির সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে ফেলে। এদের মধ্যে উল্লেখ্য : সীতা কূপ, সীতা রসুই, রঙ্গনাথ মন্দির, মানস ভবন, রাম খাজানা মন্দির, জটায়ু স্থান (স্বয়ং শ্রীরাম কর্তৃক নির্মিত), নল-নীলের টিলা, অঙ্গদ টিলা, জম্বুবান টিলা, রাম চত্বর, কথা ভবন, গবাক্ষ কিলা মন্দির, গওয়াই কিলা মন্দির, সুষেন জির মন্দির ইত্যাদি। এগুলি ছাড়াও আরো ১০০-২০০ মন্দির ধ্বংস করার পরিকল্পনা রয়েছে যার বেশ কয়েকটি ২০০-৩০০ বছর প্রাচীন।

কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের গর্ভগৃহ হিন্দুদের দানের ১২৫ কোটি টাকার খাঁটি সোনা দিয়ে বাঁধানো ছিল। মন্দির সংস্কারের নামে সরকার দ্বারা এই সমস্ত সোনা চুরি করে গর্ভগৃহে পিতল সেঁটে দেওয়া হয়।

মার্চ ২০২৩-এ বিজেপি-শিবসেনা ডাবল-ইঞ্জিন সরকার মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার তেহসিল মহলে গভীর রাত্রিতে সবার অগোচরে অতি সুপ্রাচীন জগদম্বা মন্দির ধ্বংস করে। যেসব গ্রামবাসীরা বাধা দিতে আসে, তাদের বিরুদ্ধে কেস দায়ের করা হয়। এরপর Archeology ডিপার্টমেন্ট-এর অফিসার এসে ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে দেবীর মূর্তি সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।

২০২২ সালে রাজস্থানের আলবার জেলায় ৩০০ বছরের পুরোনো এক শিব মন্দির বুলডোজার দিয়ে ধসিয়ে দেওয়া হয় [৬]। অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিজেপির মণ্ডল সভাপতি ২০১৮ সালে চিঠি লিখে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরকে মন্দির ধ্বংস করার এই প্রস্তাব দিয়েছিলো।

বিজেপি বিগত দশ বছরে পুরো ভারত জুড়ে হিন্দুত্বের সংস্কারের নামে এরকম কয়েক হাজার মন্দির ধ্বংস করেছে। মোদির মতো এতো ব্যাপক মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস স্বয়ং ঔরংজেবেরও নেই।

২০২১ বাংলা নির্বাচনে হিন্দু গণহত্যা এবং জেপি নাড্ডার মিথ্যা শপথ:

সমগ্র সভ্যতাগত অস্তিত্বের ইতিহাসে হিন্দু বাঙালির গর্ব এতটা ভূলুন্ঠিত হয় নি, যা 2021 সালের বাংলার রাজ্য নির্বাচনের পরে হয়েছিল। যখন জেপি নাড্ডা কলকাতায় এসি রুমের আরামে TMC -র বিরুদ্ধে লড়াইতে মৃত হিন্দুদের 'বিচার' দেওয়ার মিথ্যা শপথ নিচ্ছিলেন, তখন হিন্দুদের কাছে TMC-র দেওয়া মাত্র তিনটি বিকল্প ছিল [৭]:

ক) অর্থ প্রদান - 10,000 থেকে লক্ষাধিক টাকার মধ্যে যেকোনো কিছু,

খ) বাড়ির মেয়েদের টিএমসিতে পাঠান এবং এই জিহাদি উপাদানগুলি তাদের ধর্ষণের জন্য,

গ) টিএমসিতে যোগ দিন।

মোদী ও তার ৫৬ ইঞ্চি হিন্দুত্বকে সমর্থন করার এই মূল্য হিন্দু বাঙালিদের ঐতিহাসিকভাবে ২০২১-এ দিতে হয়েছে!

হিন্দুত্বের সপ্ত-সংকল্প এবং একম সনাতন ভারত:

হিন্দু সমাজের মধ্যে ভীতি তৈরি করা বহুদিন ধরেই বিজেপির কৌশল ছিল। সম্প্রতি এই কৌশল বিজেপি-র অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'বিজেপিকে নির্বাচিত না করলে হিন্দু ও হিন্দুত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে' - এই ফোবিয়া থেকে হিন্দু সমাজ খুব শীঘ্রই বেরিয়ে যাবে। এবং সমগ্র ভারতের একত্রিত হিন্দু চেতনপটে এই হাওয়া ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে। এই একত্র হিন্দুচেতনার ফলস্বরূপ শঙ্করাচার্য-সমেত সমস্ত হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা বিজেপি-র কার্যকলাপের প্রখর সমালোচনা শুরু করেছেন, গোবলয়ের বিদ্দজন সমাজ বিজেপি-র ভন্ড হিন্দুত্বের প্যাঁচ-ট্যাঁচ খুলে বিজেপি-র রাজনৈতিক পচন নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছে, বিজেপি-র নিচুতলার হিন্দু সনাতনী যোদ্ধারা 'একম সনাতন ভারত ' নামক দল বানিয়ে সনাতনী হিন্দুত্বের মঙ্গলার্থে 'সপ্ত সংকল্প' নিয়ে আগামী লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে, যেগুলি এখানে উল্লেখ্য :

1) দেশের মোট জনসংখ্যার 5% এর কম সংগঠিত একটি ধর্মীয়/ভাষাগত জনগোষ্ঠী গুলিকে "সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে" রূপে সংজ্ঞায়িত করার জন্য সংবিধান সংশোধন করা। ভারতবর্ষে কে বিশ্ব-সনাতনীদের জন্য "প্রাকৃতিক হোমল্যান্ড" হিসাবে ঘোষণা করা এবং তাদের জন্য পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকার কে সক্ষম করা।

2) হিন্দু মন্দির/মঠের উপর থেকে রাজ্য/সরকারি নিয়ন্ত্রণ শেষ করা। কাশ্মীরের প্রাচীন সূর্য মন্দির "মার্তান্ড মন্দির" এর অবিলম্বে পুনর্গঠন এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা; মথুরায় "শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি" এবং কাশীতে (বারানসী) জ্ঞানবাপি তীর্থক্ষেত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

3) কাশ্মীর থেকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু প্রদেশকে আলাদা করা; কাশ্মীরকে 2টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাজ্য হিসাবে জম্মু প্রদেশের প্রতিষ্ঠা এবং গঠন।

4) গোহত্যার উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা। এবং পবিত্র গাভী মাতা, মা গঙ্গা এবং শ্রী রাম সেতুকে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে ঘোষণা করা।

5) অবিলম্বে ওয়াকফ আইন, উপাসনার স্থান আইন 1991 এবং সাচ্চার কমিটির সুপারিশগুলির অবিলম্বে বাতিল/সমাপ্তি; ভারতের সংবিধানের 30 অনুচ্ছেদের সংশোধন করে হিন্দুদের তাদের পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও স্বায়ত্তশাসিতভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম করা।

6) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় জনসংখ্যাগত ভারসাম্য অবিলম্বে পুনরুদ্ধারের সাথে জনসংখ্যাগত আক্রমণকে ওল্টানো এবং আটক করা।

7) শুধু উন্নয়ন নয়, সত্য এবং বাস্তবিক ইতিহাসের সুদৃঢ় বলিষ্ঠ স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে সামগ্রিক উন্নয়ন। ইতিহাস, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, স্থানীয় ভাষা এবং পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতা নিয়ে পরিপূর্ণ বিকাশ!

বিজেপি ভুলে যাচ্ছে যে হাজার বছরের জেনোসাইড হিন্দুরা জনসংখ্যার হিসেবে এখনও এই বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ। মধ্যযুগের চরম অন্ধকার সময়ে হিন্দুরা যখন খিলজি ও মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করছিল তখন বিজেপির মতো জিম্মি পার্টি সেখানে ছিল না। হিন্দু ইতিহাসে বিজেপি তুলনামূলকভাবে নতুন ঘটনা। রাজনীতি এবং প্রশাসন এবং এজেন্ডায় বিজেপিকে অবশ্যই হিন্দুদের প্রতি নম্র ও অনুগত হতে হবে - অন্যথায় বিজেপি মুঘলদের মতোই আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে।

তবে মুসলিম তৃপ্তিকরণ এবং অন্যান্য ধরনের প্রতারণামূলক হিন্দুবিরোধী রাজনীতিতে বিজেপি যেভাবে সক্রিয় অংশ নিয়েছে,- তাতে হিন্দুত্বের মুখোশ পরা বিজেপি হিন্দুত্বের কালনেমি হয়ে দাঁড়িয়েছে! জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে হিন্দুরা আর একটি কংগ্রেস চায় না! কমিউনিস্ট এবং ইসলামিস্টদের সাথে বিজেপির বেশে সংসদের ভেতর আর একটি কংগ্রেস হিন্দুদের জন্য মৃত্যুর সমার্থক।

আর সনাতন হিন্দুত্বের যেহেতু মৃত্যু নেই, তাই এবিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন যে বিজেপির শেষ সন্নিকটে!

[১] https://www.youtube.com/watch?v=98Sy-ব্যসককক [২] https://www.youtube.com/watch?v=OD3QcRvvm2g [৩] https://timesofindia.indiatimes.com/india/80-temples-demolished-in-modis-capital/articleshow/3706244.cms [৪] https://twitter.com/vasukinaag/status/1653429591078502400 [৫] https://scroll.in/article/1027645/why-many-varanasi-residents-are-unimpressed-by-the-furore-around-the-gyanvapi-mosque [৬] https://munsifdaily.com/bulldozer-brings-down-300-yr-old-shiva-temple-in-rsthan-triggers-controversy/ [৭]N. K. Azad, How Mamata’s Bengal became revenge rape capital (organiser.org), 2 May 2022

No comments:

Post a Comment

সনাতন্ হিন্দু ধর্মে পবিত্র সংখ্যা ১০৮ এত মহাত্মপূর্ণ কেন...???

সনাতন্ বৈদিক হিন্দু ধর্মে, ১০৮ সংখ্যা টি অত্যন্ত পবিত্র সংখ্যা রূপে গণ্য করা হয়। কিন্তু কেন...??? কলমে :- অরিন্দম রায়। আমাদের যো...